Wednesday 3 September 2014

অচেনা যাত্রীতে আমার অনুবাদ-কাব্য

অচেনা যাত্রীর সেপ্টেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত আমার অনুবাদ কবিতা :
কবি: লুইস রাউল কালভো
দেশ: আর্হেন্তিনা
ভাষা: স্প্যানিশ
কবি, গীতিকার ও প্রাবন্ধিক।  জন্ম ১৯৫৫য় আর্হেন্তিনার রাজধানী বুয়েনোস আইরেসে। ১৯৮৮তে 'খেনেরাসিয়ন আবিয়ের্তা' পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক। ২০০০ থেকে 'দেক্লারাদা দে ইন্তেরেস কুলতুরাল দে লা সিউদাদ দে বুয়েনোস আইরেস' পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব নেন। তাঁর কবিতা লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশের কাব্যগ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। এখনো পর্যন্ত প্রকাশিত তাঁর কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ: 'যন্ত্রণাবিদ্ধ পরিত্যক্ত সময়' ( তিয়েম্পো দোলোরোসামেন্তে রেসিগ্নাদো, ১৯৮৯), 'ধাত্রীর ঘোষণা' (লা আনুনসিয়াসিয়ন দে লা পার্তেরা, ১৯৯২ ), 'এশিয়ার পথপ্রান্তর' ( কাইয়েস আসিয়াতিকোস, ১৯৯৬), 'আত্মার গভীর পটভূমি'
( বাহোস ফোন্দোস দে আল্মা, ২০০২), 'যাযাবর সৌন্দর্য' (বেইয়েসা নোমাদে,২০০৭), 'অবগাহন, এখানে-ওখানে' ( নাদা পোর আকি, নাদা পোর আয়িই, ২০০৯), 'অপবিত্র অনিশ্চয়তা' ( প্রোফানা ইনসের্তিদুম্ব্রে, ২০১০) ।
অনুবাদক: মৈনাক আদক


সৃষ্টিছাড়া ( মূল কবিতা: লা গ্রোতেস্কা )

সৃষ্টিছাড়াটা সায়ানাইডের পাথরে মাথা কুটে মরে
আগুনে নিক্ষিপ্ত, উচ্ছন্ন বোধের
উন্মত্ততায় হতাশ
যেন কুজ্জ্ঝোটিকা।
নম্রতার আলিঙ্গনে দেবদূতের কেশদাম
চুম্বন করে তার সুডৌল ডানাজোড়ায়, জিরিয়ে নেয়
দৈত্যের পাঁজরে।
কখনোসখনো আমরা মুখোমুখি হই
ছুরির ডগায়, বাস্তুহারা হই
বৈমাত্রেয় নিষ্ঠুরতায়।

দয়িত ( মূল কবিতা: লো আমান্তেস )

সুখ ও সূর্যাস্ত, আচারবিচারের গর্ভঘর
পর্যটকের সুটকেসে ভালবাসার তেরছা পথ।
কবরীতে ঝুলে থাকা তার যন্ত্রণা কুকুরের চিৎকারে দুমড়েমুচড়ে যায়।
ফাঁপা বিদ্বেষ, প্রাচীন অভিশাপ।
কারা তুলে নিয়ে গেছে অন্ধ কুকুরটাকে
যে অন্ধকারে হাতড়াচ্ছিল আলো ?
কেউই আমাদের অস্তিত্বকে মাটি থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারে না।
কিন্তু দয়িতেরা তৃষ্ণা নিবারণের স্বনির্বাচিত পরিক্রমার
উত্তেজনার জন্যও অপেক্ষা করে না।

[এই দুটি কবিতা 'ধাত্রীর ঘোষণা' (লা আনুনসিয়াসিয়ন দে লা পার্তেরা, ১৯৯২) কাব্যগ্রন্থে সংকলিত]

. অমরত্ব: এক মুহূর্তের জন্য তার বসবাস আমাদের মাঝে।
. ধর্মশালায় জীবনের বহমানতা, যেন স্থির। কখনোসখনো উতল হাওয়া, ধর্মশালার বাইরে।
. কুকর্ম আর অশুভ সময় কবিতার পিছু ধাওয়া করে।
. জনারণ্যে হারিয়ে যাওয়া। এই সূক্ষ্ম ফাঁদে আমরা মাথা গলাই আর জীবনের লেনদেন থেকে সরে যাই বহুদূর।
. আগুন... পবিত্র হৃদয় যা খুশি করতে পারে... সৃষ্টি বা ধ্বংস
. জানি, তোমায় দিতে পারব না প্রত্যাশিত রীতিনীতি। তাই ভাবি, আমার গ্লানি থেকে তোমায় মুক্ত করে দেবো।
. এই কর্মকান্ডে তোমায় চিনতে পারিনি। স্বীকার করি, তোমায় ঠিকঠাক চিনতে পারিনি কখনো।
. কতগুলো হাত তাদের অপাপবিদ্ধতা খুঁজে পায় তোমার স্তনযুগলে ?
. বাস্তবতার রহস্য উন্মোচনের জন্য মেয়েটা মাঝরাতে বেরিয়ে পড়ে। সবসময়ই পথের শেষে অপেক্ষায় থাকে এক পুরুষ। থাকবেও।

[কবিতাটি ' যাযাবর সৌন্দর্য' (বেইয়েসা নোমাদে ২০০৭) বইয়ে সংকলিত]

বাস্তব জীবন ( মূল কবিতা: লা ভিদা রেয়াল )

আসলে জীবন যেন এক অনুরক্ত  
পৌরোহিত্য।
পাহাড়িয়া নগরে, সহস্র
ভক্ত তাদের আত্মা নিমগ্ন রাখে
দেহাগ্নি প্রশমনে
বিশ্বপ্রেমের সোনালি উদারতায়,
প্রাত্যহিক ধর্মাচার আদেশ আগমনের
অপেক্ষায়।
আমরা সবকিছুই সমর্পণ করেছি
ঈশ্বরের হাতে,
ড্যাফোডিলের দেবতায় ও পবিত্র গসপেলে।
আমরা সুন্দর ও পবিত্রই ছিলাম, আমাদের স্বর্গের
মাটিও ছিল ততোধিক  পবিত্র।
কিন্তু তুমি এসব ধ্যানধারণা আর আচারবিচার
পরিত্যাগ করেছিলে, বেছে নিয়েছিলে
জ্ঞানান্ধ আর প্রতিশ্রুত রাজাদের স্বাধীনতা,
নতমস্তকে  বিচরণ করো আজ
সূর্যাস্তের পুরু কুয়াশায়
হাত বাঁধা তোমার অভিশঙ্কী ভোজসভায়।


[ কবিতাটি 'এশিয়ার পথপ্রান্তর' ( কাইয়েস আসিয়াতিকোস, ১৯৯৬) বইয়ে সংকলিত]

Sunday 3 August 2014

আমার অনুবাদে বিদেশী অণুগল্প

অচেনা যাত্রী পত্রিকার আগস্ট সংখ্যায় প্রকাশিত হল আমার অনুবাদে বিদেশী অণুগল্প:

অনূদিত অণুগল্প:
লেখিকা: লিলিয়ানা ভারেলা
দেশ: আর্হেন্তিনা
লেখক-পরিচিতি: জীববিদ্যা ও রসায়নশাস্ত্রের অধ্যাপিকা। জন্ম রাজধানী বুয়েনোস আইরেসের বেরিস্সোতে। ২০০০ সালে সাহিত্যজগতে পদার্পণ। গল্প ও কবিতা লেখেন আর্হেন্তিনা, চিলে, পেরু, একুয়াদোর, স্পেন, ব্রাসিল, অস্ট্রিয়া, ভেনেসুয়েলা ও কোলোম্বিয়ার বিভিন্ন সাহিত্যপত্রে। তাঁর উল্লেখযোগ্য কিছু বই: বিভিন্ন গল্প-২০০৬, অন্ধকার কবিতা, আমার লেখা-২০০৮, না-ঘুমপাড়ানীয়া গল্প ইত্যাদি। ১৮টি স্প্যানিশভাষী দেশের কবিদের সাথে সম্পাদনা করেন 'সূর্যের কথা' নামের আন্তর্জাতিক পত্রিকা। রাদিও আরিন্ফোয় 'আল বোর্দে দে লা পালাব্রা' অনুষ্ঠানের সঞ্চালিকা, অন্য দেশের কবিদের কবিতা পাঠ করেন এই অনুষ্ঠানে। শিকাগোর কসমস রেডিওর 'ভোসেস দেল সুর' অনুষ্ঠানের সঞ্চালিকা ২০১২ থেকে।
অনুবাদক: মৈনাক আদক

তাড়না ( মূল গল্প: ইমপুলসো )

ওরা কিছুতেই নিজেদের সংযত করতে পারল না। এক আত্মঘাতী বাদলা বিকালে রাস্তায় পড়ে রইল ওদের পদদলিত দেহাবশেষ।

কণ্ঠস্বর শুনতে হলে ( মূল গল্প: ওইর লা ভোস )

সত্যিটা কিভাবে স্বীকার করতে হয়। অন্তর্বেদনার ভারে ভেঙেচুরে যায় তার হাড়পাঁজরা, কেননা তার মনে হচ্ছিল সে আর আগের মতো নেই। আজ সে শুধু একজন মহিলার প্রতিফলন দেখছিল আয়নায়, নিজেকে দেখে তার ঘেন্না হচ্ছিল।
জলের ঢেউ হতাশায় চাটছিল মেয়েটার দু পায়ে লেগে থাকা বীর্যের অবশিষ্টাংশ যতক্ষণ না সে শুনতে পাচ্ছিল তার মায়ের আকুল কণ্ঠস্বর।
জলীয় শীতলতা সে অনুভবই করেনি, মাকে খুঁজতেই ব্যস্ত ছিল। অপরাধবোধের অশ্রু এবং অ্যালকোহলে নিমজ্জিত তার বাবার নাক ডাকার আওয়াজও পৌছয়নি তার কাছে।


* দুটি অণুগল্পই না-ঘুমপাড়ানীয়া গল্প ( ২০০৮ ) বইয়ে সংকলিত।

অণুগল্প

অনেকদিন আগে আমার এই অণুগল্পটি তথ্যকেন্দ্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল:

আশ্রিতা
আমার ট্রান্সফার অর্ডার এসে গেছে। ফিরে যেতে হবে মধ্যপ্রদেশের সেই জঙ্গলমহলে, যেখানে শৈশব থেকে চাকরিতে যোগ দেওয়া... সবই ক্রমানুসারে ঘটে গেছে। পুরোনো দেশে ফিরতে পারব আবার। স্বস্তি আর আনন্দ মিলেমিশে অস্থির করে তুলছে আমায়। হঠাৎই চোখ দুটো বারান্দার দিকে চলে গেল। আমার আশ্রিতা বৃদ্ধা বসে আছেন স্থির। শেয়ালদা স্টেশনে ওঁর ছেলেরা ওনাকে ফেলে পালিয়েছিল গঙ্গাসাগরের মেলার সময়। একাই থাকি এই ফ্ল্যাটে। কিছু না ভেবেই আশ্রয় দিয়েছিলাম সেদিন। একদিনেই অগোছালো এই ফ্ল্যাটের আবহ বদলে গেল আমূল। কে যে কার আশ্রিত বুঝিনি ঠিকমতো। আমি চলে গেলে ওনার কি হবে, ভাবিনি। টুকরো টাকরা জিনিসপত্র নিজের ছোট্ট ব্যাগটায় গুছিয়ে নিচ্ছেন অচেনা দেশের আমার 'জেঠিমা', যেভাবে যাযাবররা যাওয়ার আগে নিজেদের তাঁবু তুলে নেয়। পড়ে থাকে বাঁশ পোঁতার গর্ত আর খাঁ খাঁ শূন্যতা। বারান্দার দিকে তাকিয়ে মনটা হু হু করে উঠল। আস্তে আস্তে জেঠিমার পাশে মেঝেতে বসে পড়লাম।
' কী করছেন জেঠিমা?'
'বাড়ি যাবো বাবা। তুমি তো ফিরে যাবে বাবা মায়ের কাছে...'
'কাজের ট্রান্সফার যে জেঠিমা! না হলে...কিন্তু আপনি কিভাবে বাড়ি ফিরবেন ? তার চেয়ে আমরা
একসঙ্গেই মধ্যপ্রদেশে যাই না ? আমার বাবা-মাও আপনার সঙ্গ পেলে মন খুলে গল্প করবেন।
আপনারও ভাল লাগবে, দিন কেটে যাবে সুখে-সান্নিধ্যে !'
' না বাবা, তা হয় না। এই সবুজ মাঠ, নরম মাটির গন্ধ ছেড়ে ভিনদেশে মরতে পারব না। ছেলেদের হাতের আগুনই চাই যে আমার !'
' কিন্তু----'

' না বাবা, মনে কোরো দুদিন দেখা হয়েছিল আমাদের, তারপর---' চোখের জল মুছে বৃদ্ধা বলে উঠলেন--- ' তোকে ভালোমন্দ কিছুই খাওয়াতে পারিনি রে পুলু। আজ একটু ইলিশ এনে দিস তো ! এমন রাঁধব, স্বাদ ভুলতে পারবি না।'

আমার অণুগল্প

অচেনা যাত্রী পত্রিকার আগস্ট মাসের অণুগল্প সংখ্যায় প্রকাশিত আমার অণুগল্প:
জগৎ
ঘুরে ঘুরে বাজার করছে অনিমেষ, অনেকদিন পর রাতের পর রাত হুইস্কিতে ডুবে থাকা সিনিয়র এক্সিকিউটিভ অনিমেষ মিত্র মামার জন্য কিনছে সুগন্ধী বাসমতী বাবা বড় ভালবাসত কালবোশ মায়ের জন্য বাটা, দাদার পাঁঠার মাংস, দিয়া? অনিমেষের প্রথম পাপ, প্রেম বকুলগন্ধ শরীরে মেখে আমসত্ত্ব খেতে বড় ভালবাসত ফুলপিসির জন্য গাওয়া ঘি, দাদুর জন্য চাঁপা কলার মোচা, গন্ধরাজ লেবু, মোচা-চিংড়ি, মাছের ডিমের বড়া গন্ধরাজ লেবুর গন্ধমাখা ভাতের সঙ্গে বড় প্রিয় ছিল ওর-
একবোঝা বাজার নিয়ে টানারিকশায় বসে যেতে যেতে ওর মনে পড়ে যাচ্ছে কৈশোরে গ্রামের সেই দিনগুলোর কথা--- ট্রেনের ছুটে যাওয়া, দাদুর সঙ্গে মোহনবাগান মাঠে যাওয়া, দিয়ার সঙ্গে বর-বউ খেলা

ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে সম্বিত ফিরল অনিমেষের  ফিরতে দেরি হয়ে গেছে অনেক ডোরবেল বাজাল অনেকবার, অথচ খুলছে না কেউ পুরোনো দিনের অভ্যেস মতো বোধহয় সন্ধ্যা হতেই ঘুমিয়ে পড়েছে সবাই  নাহ্, সাড়াশব্দ নেই কারো অগত্যা পকেট থেকে ডুপ্লিকেট চাবি বের করে দরজা খুলল অনিমেষ ঘর অন্ধকার দেওয়াল হাতড়ে হাতড়ে  আলো জ্বালল, পাশের ঘরে গেল তার পাশেরটায়, ব্যালকনিতে নাহ্, কেউ কোথাও নেই ক্ষণিকের জন্য  এসে অনিমেষের মৃত আত্মীয়রা আবার ফিরে গেছে আপাদমস্তক পেশাদারীত্বে মোড়া প্রৌঢ় অনিমেষের জন্য ফিরিয়ে দিয়ে গেছে মাটি, রোদ্দুর, বৃষ্টি, স্বাদ-বর্ণ আর বকুলের গন্ধমাখা এক হারানো অপার্থিব জগৎ